কুয়া

 কুয়া

ভালোই ছিল কাশিনাথপুরের মানুষ। গ্রামের প্রান্তে ছোট শান্ত নদী। সেখান থেকে বিস্তীর্ণ ফসলের খেত শুরু। তাতে বছরে দুই এমনকি তিনবারও ফসল হয়। গ্রীষ্ম-শীত কোনোটারই বাড়বাড়ন্ত নেই। শুধু বর্ষাকালে বৃষ্টি হয় অকাতর। নদী বেয়ে সেসব দ্রুত চলে যায় বলে বন্যাটন্যারও বিশেষ উপদ্রব নেই। গ্রামের মাঝখানে প্রকাণ্ড বটগাছকে ঘিরে বাজার বসে। দোকানপাটের পাশাপাশি এখানে ডাকঘর, মাধ্যমিক স্কুল, মাদ্রাসা, মন্দির—সবই আছে। সেই সঙ্গে আছে কাশিনাথপুরের বিখ্যাত জমিদার ত্যাগনারায়ণ চৌধুরীর বাড়ি। দানশীল ভদ্রলোক বলে ত্যাগনারায়ণের খ্যাতি আছে। সবাই পেটেভাতে ভালো ছিল বলে এলাকায় অশান্তি বড় একটা নেই। কিন্তু গোল বাধল দেশভাগের পর।


পঞ্চাশের দাঙ্গায় ত্যাগনারায়ণের একমাত্র ছেলে মুকুন্দ অস্থির হয়ে উঠলেন। তিনি তত দিনে কলকাতায় পড়াশোনা শেষ করে রীতিমতো থিতু হয়েছেন। দেশের বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ বড় একটা নেই। খবরাখবর যা পান তা লোকমুখে, নয়তো আনন্দবাজার-স্টেটসম্যান পত্রিকা মারফত। ফেলে আসা দেশের সংবাদ স্বভাবতই বড় বীভৎস ও বিপজ্জনক শোনায় তাঁর কানে। বাবাকে আগে থেকেই চলে আসার জন্য পত্রাঘাত করছিলেন তিনি। দাঙ্গার খবর শুনে চরমপত্র দিয়ে বসলেন। চিঠি পাওয়ামাত্র চলে না এলে যোগাযোগ বন্ধ করবেন।


ত্যাগনারায়ণ তত দিনে অশীতিপর বৃদ্ধ হয়েছেন। ভেবেছিলেন জীবনের বাকি দিনগুলো পূর্বপুরুষের বাড়িতেই কাটিয়ে গ্রামের মাটিতেই ভস্ম হয়ে মিশে যাবেন। কিন্তু দাঙ্গার ভয়াবহতা তাঁকেও নাড়িয়ে দিল। বোঝার উপর শাকের আঁটির মতো যুক্ত হলো ছেলের কড়া ভাষার চিঠি। উপায় না দেখে এক রাতের নোটিশে তিন পুরুষের পুরোনো বাড়ি ছেড়ে প্রায় খালি হাতে কলকাতার ট্রেনে উঠে বসলেন। কাশিনাথপুর থেকে সেটাই ছিল তাঁর চিরপ্রস্থান।


তখন ছিল মাঘ মাস। শীত বেশ জেঁকে পড়েছিল। কথা ছিল দাঙ্গার হাঙ্গামা কমলে ত্যাগনারায়ণ বাড়িতে ফিরে আসবেন। কিন্তু গঙ্গায় বেড়াতে গিয়ে সলিলসমাধি ঘটলে তাঁর আর ফেরা হলো না।


বেশ কিছুদিন বাড়িটি পড়ে রইল। ভিক্টোরিয়ান ধাঁচের প্রকাণ্ড সাদা বাড়িটি কাশিনাথপুরের আর দশটি বাড়ির সঙ্গে মেলে না। যেন মরুর মাঝখানে বসরাই গোলাপ ফুটেছে। তেমন সাড়ম্বর না হলেও কাছাকাছি বাড়িটি তছিরুদ্দিন ব্যাপারী ওরফে পাতারুর। ইনি কাশিনাথপুরের মুসলমান সমাজের মাথা। পাটের ব্যবসা করে দুহাতে অর্থ কামিয়েছেন। এককালে ত্যাগনারায়ণকে সমীহ করলেও পাকিস্তান আন্দোলনের শুরু থেকে দুই বাড়ির মুখ দেখাদেখি নেই। তারপরও ত্যাগনারায়ণ বাড়ি–ভিটা ত্যাগ করে দেশান্তরী হলে মনে মনে একটা সূক্ষ্ম ব্যথা অনুভব করলেন তিনি। অত বড় বাড়িটা পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছে দেখে বুকের ভেতরটা বসন্ত বাতাসের মতো হু হু করে উঠল তাঁর। মুকুন্দনারায়ণ চৌধুরীর সঙ্গে চিঠি চালাচালি করে, সদ্য ছাপানো পাকিস্তানি রুপির একতাড়া নোট রেজিস্ট্রি ডাকে পাঠিয়ে তিনি বাড়িটি হস্তাগত করলেন।



জমিদারবাড়িটি ভেতরে যেমন, বাইরেও তেমন পরিপাটি করে সাজানো। যদিও কয়েক মাসের অযত্নে আগাছা ও সাপখোপের উৎপাত বেড়েছে। দোতলার খিড়কিগুলোর ওপরে কবুতর আর ঘুলঘুলির ভেতরে চামচিকা বাসা বেঁধেছে। তবে শানবাঁধানো ঘাটে এখনো কাকচক্ষু জল টলমল করে। আদ্যিকালের শেওলা জমা প্রকাণ্ড রুই-কাতলা খেলাচ্ছলে ঘাঁই মারে নিতান্ত আলস্যে। দেখেশুনে বড় ভালো লাগে পাতারু ব্যাপারীর।


যদিও বাড়ির চেয়ে তাঁর নজর মূলত বাইরের দিকে। ত্যাগনারায়ণ দেশত্যাগের আগে সম্পদটম্পদ সেভাবে গোছানোর সময় পাননি। শোবার ঘরে বিলেতের চাব অ্যান্ড সন্স কোম্পানির সিন্দুক পাওয়া গেলেও টাকাকড়ি কিছু পাওয়া যায়নি। পাতারু ব্যাপারী নিশ্চিত যে ত্যাগনারায়ণের তিন পুরুষের সঞ্চিত ধন ট্রেনে করে নিয়ে যাওয়ার অবস্থা ছিল না। বাড়ির কোথাও না কোথাও সেসব লুকানো আছে।


যে–ই ভাবা, সে–ই কাজ। পাতারু ব্যাপারী লোক লাগিয়ে আগাছা ছেঁটে ফেললেন। মাটি খুঁড়ে, তন্ন তন্ন করে খুঁজে সব জমি চষে ফেললেন। জেলে ডেকে, জাল ফেলে মহা আড়ম্বরে পুকুরের সব মাছ ধরা হলো। সমুদ্রমন্থনের মতো করে কাদা ঘেঁটে তুলে আনা হলো বহুদিন আগে হারিয়ে যাওয়া কাঁসার বাসন, নাকের নথ, কানের দুল, এমনকি একটি দুই ভরি ওজনের সীতাহার। কিন্তু পাতারু ব্যাপারীর কাঙ্ক্ষিত টাকাভর্তি হাঁড়ি কিংবা গয়নাভর্তি বাক্সের টিকিটিরও দেখা মিলল না।


বাড়ি ঘিরে মহাতাণ্ডবের পর পাতারু ব্যাপারী যখন টাকাকড়ির আশা প্রায় ছেড়ে দিয়েছেন, এমন সময় জমিদারবাড়ির পুরোনো চাকর জ্ঞানেন্দ্র এল দেখা করতে। সে এককালে ত্যাগনারায়ণের খাসচাকর ছিল। এখন বয়স হয়েছে বলে তেমন কানে শোনে না, চোখেও দেখে না। কিন্তু কণ্ঠস্বরে তেজ আছে। সে এল একটা প্রস্তাব নিয়ে।


ধড়িবাজ জ্ঞানেন্দ্র বলল, ‘হুজুর, আপনি জমিদারবাড়ি কিনে নিয়েছেন। এই বাড়ির সব অংশের ওপর আপনার অধিকার জন্মেছে। আপনি চাইলে আমি সব খবর দিতে পারি। শুধু যদি আমাকে একটা চাকরি দিতেন। দুটো খেয়ে–পরে বাঁচতে পারলে বর্তে যাই।’


পাতারু চালাক মানুষ। তাঁর জন্য ইশারাই কাফি। সঙ্গে সঙ্গে দুই মাসের অগ্রিম বেতন দিয়ে জ্ঞানেন্দ্রর চাকরি পাকা করে ফেললেন। নতুন প্রভুর কানে ফিসফিস করে কিছু একটা বলল জ্ঞানেন্দ্র। শুনে পাতারুর চোখ জোড়া চকচক করে উঠল।


বাড়ির সব অংশ উল্টেপাল্টে দেখলেও পানি খাওয়ার পাতকুয়ায় টাকাপয়সা লুকানো থাকতে পারে, সে কথা কেউ ভাবেনি। জ্ঞানেন্দ্র ফিসফিস করে সেদিকেই ইঙ্গিত করল।


অমনি বাড়িজুড়ে হুলুস্থুল পড়ে গেল। পাতারু হুকুম করলেন, ‘এক্ষুণি ঝালাইকারকে ডেকে নিয়ে এসো।’


ঝালাইকর হলো সেই ব্যক্তি যে কুয়া পরিষ্কার রাখে। প্রতি এক কি দুই বছর পর চৈত্র মাসে যখন পানির স্তর শুকিয়ে কুয়া প্রায় বুজে যাওয়ার উপক্রম হয়, তখন ডাক পড়ে ঝালাইকারের। সে কুয়ায় নেমে ভেতরে জমে থাকা পলি, আবর্জনা, কুয়ার প্রাচীরে জন্মানো ঢেঁকিশাক, ছোটখাটো প্রাণী ইত্যাদি তুলে ভেতরটা পরিশুদ্ধ করে। প্রয়োজনে কুয়ার ক্ষয়ে যাওয়া ইট, সুরকি মেরামত করে। এমনকি অসাবধানতাবশত পড়ে যাওয়া ঘটি, বালতি ও স্বর্ণালংকার তুলে আনার কাজও করে।


কাশিনাথপুরে তখন ঝালাইকারের কাজ করে এমন মানুষ একজনই ছিল। তার নাম মন্দিল দাস। কিন্তু মন্দিল বড় বুড়ো হয়েছে। এককালের তন্দুরস্ত পেশি এখন শিথিল হতে শুরু করেছে। দুই চোখের তারার দিকে তাকালে খালি চোখে ঘোলাটে ছানি দেখা যায়। তার চেয়ে বড় কথা, কিছুদিন ধরে তার অসুখ করেছে। গায়ে বেশ জ্বর। পুরো শরীরে অবসাদ ঝিম ধরে আছে। সবচেয়ে আচানক কথা, পানির ওপর আতঙ্ক তীব্র হয়েছে। যে মন্দিল একদিন হেসেখেলে বর্ষার ভরাট নদী এপার-ওপার সাঁতরে পার করেছে, গভীর কুয়ায় ডুবে জীবিকা অর্জন করেছে, সেই মানুষ যেন আর নেই।


জ্ঞানেন্দ্র কাজের খবর নিয়ে মন্দিলের বাড়িতে গিয়ে দেখে, ভজহরি কবিরাজ তাকে দেখতে এসেছে। ভজহরি ঘড়েল লোক। রোগের কেবল উপসর্গ নয়, গোড়া থেকে চিকিৎসায় বিশ্বাস করে। সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করে জানল, মাসখানেক আগে মন্দিলের পোষা হুলো বেড়ালটি তাকে আঁচড়ে দিয়েছিল। রেগে গিয়ে মন্দিল তাকে তাড়িয়ে দেয়। মন্দিলের বর্ণনা শুনতে শুনতে ভজহরির মুখ থমথমে হয়ে উঠল। কবিরাজসুলভ গাম্ভীর্যের মুখোশ খসে তার মুখে ফুটে উঠল গভীর দুশ্চিন্তা। সে বিড়বিড় করে বলল, ‘তোমার বর্ণনা শুনে মনে হচ্ছে, আলর্কবিষ রোগ হয়েছে। ধুতুরা-শরপুঙ্গা যোগের চিকিৎসা করে দেখতে পারি। তবে একেবারে আশ্বস্ত করতে পারছি না। তুমি ভাই জল থেকে একেবারে দূরে থাকবে।’


কবিরাজ-রোগীর আলাপচারিতা জ্ঞানেন্দ্র গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। সে বাগড়া দিয়ে বলল, ‘কিন্তু কবিরাজ মশাই, আমি যে ঝালাইকারের কাছে জমিদারবাড়ির কুয়া পরিষ্কারের কাজ নিয়ে এসেছি। কাজটা করে দিলে আমার চাকরি পাকা হয়। মন্দিলও ভালো বকশিশ পাবে।’


ভজহরি যেন কথা বলতে ভুলে গেল। জলাতঙ্ক রোগী নামবে জলভর্তি কুয়ায়? কে কবে শুনেছে এ রকম উদ্ভট কথা? সে বলল, ‘কেন? মন্দিল ছাড়া আশপাশের দশ গ্রামে আর কোনো ঝালাইকার নেই? তাদের কাউকে দিয়ে কাজটা করুন। সে ভীষণ অসুস্থ। জলের কাছে গেলে খারাপ কিছু হতে পারে।’



জ্ঞানেন্দ্র বলল, ‘জমিদারবাবু মন্দিল ছাড়া কাউকে কখনো ওই কুয়ায় নামতে দেননি। সে যেভাবে কুয়াটা চেনে, চোখ বেঁধে নামিয়ে দিলেও ওঠানামা করতে পারবে। তা ছাড়া টাকাটা পেলে ওর বউ-ছেলেপুলের বিরাট উপকার হবে। আমি পাতারু ব্যাপারীকে বলে এক শ টাকা বকশিশের ব্যবস্থা করে দেব।’


টাকার কথা শুনে মন্দিলের দ্বিধার দেয়াল ধসে পড়ল। সে জানে তার মৃত্যু আসন্ন। জল কেন, বাতাস বইলেও তার ভীষণ ভয় লাগে। শ্বাসতন্ত্র বজ্রমুষ্ঠিতে চেপে ধরে কে যেন গলা টিপে মারতে চায়। সারা জীবন অন্যের কুয়া পরিষ্কার করে দুটো কুঁড়েঘর ছাড়া আর কিছুই রেখে যেতে পারবে না সে। ঘরভর্তি ছেলেপুলে নিয়ে তার স্ত্রী গিয়ে দাঁড়াবে, এমন কোনো দুয়ারও নেই। সে চিঁ চিঁ করে বলল, ‘চলুন।’


জমিদারবাড়ির কুয়াটি প্রকাণ্ড। চ্যাপটা ইট ও সুরকি দিয়ে বাঁধানো প্রায় চল্লিশ ফুট গভীর কুয়াটি ত্যাগনারায়ণের ঠাকুরদার আমলের। মন্দিল ছোটবেলা থেকে বহুবার এই কুয়ায় নেমেছে। ভেতরের প্রতিটি ফাটল তার মুখস্থ। কিন্তু আজ এতগুলো বছর পর কুয়ায় উঁকি দিয়ে তার পুরো শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল। ফাঁদে পড়া হরিণশিশুর মতো সে থরথরিয়ে কাঁপতে শুরু করল।


খবর পেয়ে পাতারু ব্যাপারী সেখানে হাজির হয়েছেন। কঠোর গোপনীয়তার মধ্যে শুরু হলো মন্দিলের কাজ। সে প্রথমে নোঙরের মতো দেখতে একটি আংটা দড়িতে বেঁধে কুয়ায় নামিয়ে দিল। ভালো করে নেড়েচেড়ে, বিচিত্র কৌশলে কুয়া থেকে তুলতে লাগল কাঁসার থালা, চিলিমচি, ঘটি, এমনকি চামচ পর্যন্ত। জ্ঞানেন্দ্র খুশি হলেও তার মনিব কিন্তু ততটা সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। তিনি বললেন, ‘এভাবে হবে না। কুয়ায় নেমে খালি হাতে খুঁজে দেখো।’


জ্ঞানেন্দ্র তাকাল মন্দিলের দিকে। তার মুখ শুকিয়ে কিশমিশের মতো হয়ে গেছে। চোখের তারায় ভর করেছে ভয়। একটি প্রকাণ্ড বাঁশ কুয়ায় নামিয়ে দিয়ে ঈশ্বরের ৯ লাখ কোটি নাম থেকে কয়েকটি জপে মন্দিল ছায়ার মতো নেমে পড়ল কুয়ায়। তার হাতে লোহার আঁকশির মতো একটি অস্ত্র। কোমরে বাঁধা পুরোনো দড়ি। বহুবার এই পথে ওঠানামা করেছে সে। কিন্তু আজ যেন মনে হলো, এবারই শেষ। এখান থেকে আর উঠে আসতে পারবে না। ঠোঁটের কোণে থুতু জমেছে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। পাঁজরের ভেতর অনিয়ন্ত্রিতভাবে লাফাচ্ছে হৃৎপিণ্ড। হাত ও পা জোড়ার ওপর তার যেন কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।


কিছুদূর নামার পর কুয়ার স্বচ্ছ সবুজ পানি চোখে পড়ল মন্দিলের। অমনি প্রচণ্ড আতঙ্ক তাকে গ্রাস করে নিল। অসাড় আঙুলের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সে পানিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। তার মনে হলো, এ যেন তরল আগুন। নরকের চুল্লি থেকে উঠে এসে তার সর্বাঙ্গ জ্বালিয়ে দিচ্ছে। ভয় পেলেও কাজটা ভোলেনি মন্দিল। সে অবাধ্য আঙুল দিয়ে নাকমুখ ঢেকে ডুব দিল কুয়ার তলদেশে। কী আশ্চর্য, ডোবামাত্র তার হাতে ঠেকল একটা প্রকাণ্ড ভারী সিন্দুক। পানির ওপর ভুস করে ভেসে সে সিন্দুকটার কথা বলতেই কুয়ার মুখে ঝুঁকে থাকা পাতারু দড়ি বেঁধে তুলে দিতে বললেন।


কোমরের দড়ি খুলে সিন্দুকের হাতলে বাঁধল মন্দিল। ইচ্ছার বিরুদ্ধে, অনিয়ন্ত্রিত স্নায়ুর ওপর প্রবল জোর খাটিয়ে, দমবন্ধ পরিস্থিতিতে কীভাবে সে কাজটা করল, সেটা ব্যাখ্যাতীত। দড়ি বাঁধা হলে সে একটা টান দিয়ে সংকেত দিল। অমনি পাতারু ব্যাপারীর নির্দেশে বাড়ির সব চাকরবাকর সিন্দুকটা টেনে তুলতে শুরু করল।


অত বড় একটা সিন্দুক, কুয়ার তলায় কীভাবে পড়ে ছিল, সেটাই আশ্চর্যের। অবসন্ন শরীরে সিন্দুকটির ধীরে ধীরে ঊর্ধ্বযাত্রা দেখতে দেখতে প্রবল ভয় মন্দিলকে গ্রাস করল। সে যেন ছিপি আঁটা এক বোতলে আটকা পড়েছে। চাইলেও বের হতে পারবে না, এই ভাবনাই তার হৃদয়ে তুমুল কম্পন শুরু করল। এত দিনের অভিজ্ঞতা যেন সে একলহমায় ভুলে গেল।


ভজহরি কবিরাজের কথাগুলো মনে পড়ল মন্দিলের। জাতনিমের পাচন আর ছাই খাইয়ে সে জলাতঙ্ক রোগের চিকিৎসা করবে বলেছিল। ভাবতেই চারপাশে তাকিয়ে আশ্চর্য হয়ে গেল সে। তার কোমর পর্যন্ত সবুজ পাচন ও ধূসর ছাইয়ে বোঝাই। মনের ভেতরে কে যেন বলল, ‘খা।’


অমনি মন্দিল প্রবল উৎসাহে কুয়ার পানি খেতে শুরু করল। জলের আতঙ্ক কিংবা বন্দী হওয়ার ভয়, কোনোটাই তার মনে প্রভাব ফেলল না। শরীরের সব অবসন্নতা কাটিয়ে তার যেন নতুন করে জন্ম হলো। বৃদ্ধ, রোগাক্রান্ত শরীরের খোলস বদলে যেন জন্ম নিল নতুন মন্দিল।


এদিকে সিন্দুকটি প্রায় কুয়ার মুখ পর্যন্ত উঠে এসেছে। আরেকটু টানলেই উঠে আসবে। তারপর পাতারু ব্যাপারীর পোয়াবারো। তিনি আবেগে আরও জোর খাটানোর নির্দেশ দিতেই বাধল বিপত্তি। পুরোনো ভেজা দড়ি শুকনা লতার মতো মট করে ছিঁড়ে গেল। সিন্দুকটি আর ওপরে উঠল না। ভূতলের টানে প্রবল গতিতে আছড়ে পড়ল কুয়ার তলদেশে। মন্দিলের প্রাণহীন দেহ ভারী সিন্দুকের নিচে চাপা পড়ল। কেউ জানতেও পারল না, মৃত্যুর আগে মন্দিল ঝালাইকার সম্পূর্ণ সেরে উঠেছিল।


প্রথম আলো

গল্প

কুয়া

নিয়াজ মেহেদী

প্রকাশ: ২৩ মে ২০২৫

However, his master was not so satisfied. He said, ‘It won’t happen like this. Go down into the well and search with your bare hands.’


Gyanendra looked at Mandil. His face had become as dry as a raisin. Fear filled his eyes. Lowering a huge bamboo stick into the well and chanting the nine lakh crore names of God, Mandil descended into the well like a shadow. He had a weapon like an iron crowbar in his hand. An old rope tied around his waist. He had walked up and down this path many times. But today it seemed like this was the end. He would never be able to come up from here again. Spit had gathered at the corners of his lips. His throat had become dry and wooden. His heart was beating uncontrollably inside his ribs. He seemed to have no control over his hands and feet.


After going down a little distance, Mandil saw the clear green water of the well. At that moment, a great panic engulfed him. He lost control of his numb fingers and fell headlong into the water.  It felt like liquid fire. It had risen from the furnace of hell and was burning him all over. Even though he was scared, Mandil did not forget his task. He covered his nose and mouth with his disobedient fingers and dove into the bottom of the well. What a surprise, as soon as he dove, a huge, heavy chest hit his hand. As soon as he spoke of the chest, which was floating on the water, he asked to tie the rope of the scythe that was leaning against the mouth of the well.


Mandil untied the rope around his waist and tied it to the handle of the chest. Against his will, exerting great force on his uncontrolled nerves, in a suffocating situation, it is inexplicable how he did the job. When the rope was tied, he gave a signal with a tug. Immediately, on the orders of the scythe dealer, all the servants in the house started pulling the chest.


It was amazing how such a large chest could lie at the bottom of the well. Seeing the chest slowly rise up in his exhausted body, a strong fear engulfed Mandil.  It was as if he was trapped in a bottle with a cork. Even if he wanted to, he would not be able to get out, this thought started to tremble violently in his heart. It was as if he forgot all the experiences of so many days in an instant.


Mandil remembered the words of Bhajahari Kabiraj. He had said that he would cure rabies by eating the digesta and ashes of Jatnim. Thinking this, he looked around and was surprised. He was loaded up to his waist with green digesta and gray ashes. Someone in his mind said, ‘Eat.’


Omni Mandil started drinking well water with great enthusiasm. Neither the fear of water nor the fear of being imprisoned affected his mind. After overcoming all the fatigue of his body, it was as if he was born anew. It was as if a new Mandil was born by replacing the shell of his old, diseased body.

Meanwhile, the ark had almost reached the mouth of the well. If you pull it a little more, it will come up. Then the pawnbroker's foot came. As soon as he emotionally ordered them to exert more force, the danger increased. The old wet rope twisted and tore like a dry vine. The ark did not rise any more. It crashed to the bottom of the well with great speed due to the pull of the earth. Mandil's lifeless body was buried under the heavy ark. No one could even know that Mandil Jhalaika had completely recovered before his death.


Prothom Alo


Story


Well


Niaz Mehdi


Published: 23 May 2025


x

মন্তব্যসমূহ

https://chotaderagalpa.blogspot.com/?m=1

অভিজ্ঞতা

একটি গাছ এবং একজন পথিক

বুদ্ধিমান কাক